রোদ ছাড়িয়ে ছায়া
জৈষ্ঠ্যের দ্বিপ্রাহরিক
আলো বরাবরের মতন এবারটাও ঠাঁ ঠাঁ৷
ভজন আর কুসুম মোল্লা ছায়া খুঁজে নিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে আশ্রম কোয়ার্টারের পাঁচ মানুষ
প্রমাণ উঁচু মুখোমুখি দুই দেওয়ালের মাঝ বরাবর পথে ৷ রাস্তাটা মুরারী পাড়ার বড় মোড়
থেকে ঢুকে এসে সর্পিল গতিতে দু'ধারে সেবাময় আশ্রমের দেওয়ালে
বর্ডার করা খোপ খোপ ঘরের কর্মী আবাসকে পাশে রেখে বইতে বইতে মিশে গেছে জন্নত কালী
হাই রোডের অ্যাসফল্ট পিচে ৷ বড় মোড় আর জন্নত রোডকে যোগ করার নিউমেরিক্যাল সাইন এই
পথে আনাগোনার বেশী লোকের নেই ৷ ডাঙ্গা পাড়াকে বেড়ি পড়িয়ে ঘুর নিলে কালীর মুখে
পৌঁছানো যায়, সেখানে বেফালতু হয়ে যাবে আশ্রমের শীর্ণ স্রোতে
পা বাড়ানো !
ছায়াচ্ছন্ন পথের এমন
গ্রীষ্ম দুপুরে কুসুম ডান বগলে তেল চকচকা বাঁশটা গুঁজে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ভজনের
রিক্সাখানায় ৷ মাথার ছইটাকে দাঁড় করাতে আর ভাঁজ করে শোওয়ানোয় চাঁছা বাঁশের যে তিন
কঞ্চি কাঠ লাগে তার গায়ে হেলান দেহ মেরে ৷ ভজন প্যাসেঞ্জারের বসার জায়গায় বসে পা
ছড়িয়ে চালক সিটে ৷ কনুই-এ আলতো ভর যাত্রী আসনে, খৈনি ডলছে , খসখসা হাতের চেটো, তামাক কাটা ধূসর সাদা বর্ণ ৷
তর্জনী আর বুড়াঙ্গুলের শীর্ষে ধরা সবজে কৌটা থেকে চুন নিয়ে একদান শেষ ফিনিশিং রগড়ে
প্রথম কুসুমকে দেয় অর্ধেক বেশীর এক ছটাক বেশী, নিজে মুখে
তোলে এক চিমটে ৷ কিছুক্ষণ আগে নাড়ুর দোকানেই চা নেওয়ার সময় মেরেছিল স্পেশাল কাটা
চমন খৈনী — এখন অল্প যথেষ্ট ৷ কুসুম মোল্লা মুখ ঠুসে বলে —
হাঁ রে, ভজন প্রাইমিনিস্টার ক'টায় আসছে রে সভার মাঠে ?
ভজন চোখ বুজে ছিল কাঁধ
মাথা বেঁকিয়ে, পিটপিটিয়ে চায় কুসুমের মুখে— ওখানে গেলে
কিস্যু হাতে আসবে না রে খোঁড়া, দেখবি উল্টে প্রধানমন্তীর
কালো লেজুড় এসে কেলায়ে আরেক পায়া খোঁড় করে মাঠ হতে হদিশ করে দিল, ওখানে পাবিনা রে মানুষের দান-ভিক্ষা বোঝ এটা আগে উজবুক ৷
কুসুমের ডান হাঁটুর তলার
অংশ থেকে পা আর নেই, থকথকে পুঁজ রক্তের দাগ ৷ সেদিক তাকিয়ে ভজন
বলে ,
— ক'দিন আর গজ তুলার কেরামত দেখাবিরে নুলো, বিবিরে ক'
এবার, আর করতি হবে না বৌ তোমায় হামানদিস্তায়
আলতা দুব্বো হলুদ চেঁছে এ পাপ তৈরী ৷
— ওয় ঘাওড়া
পা'খান কী সত্যি রইছে, দেখ তো মারা,
ছ'বছর আগে তো বাস দিল খসিয়ে ঠ্যাঙ.. এখন ঘা
শুকালেও একটু যদি অ্যাক্টো না হয়, খাব কী সে ! বলেই কুসুম
চটাস করে একটা থাপড় কষায় রিকশাওলা ভজনের পাছায় ৷
— উফ্
শালাআআ, ফোঁড়াটা গাইলা দিলি রে হারামজাদা মুল্লাআআ ৷
কঁকিয়ে উঠে লুঙ্গির ওপরে
থুপ থুপে হাত বোলাতে থাকে ৷ কুসুম এবড়ো খেবড়ো মজাকি দাঁত বার করে হাসতে থাকে যেন
ফোঁড়া ফাটিয়েই ভজনের হোমিওপ্যাথ খরচের কাজ সেরে দিয়েছে নিজেই ৷
— তা'লে বল মন্তী ক'টায় আসবে, তোর
ফোঁড়া কাটিয়ে দিলাম, বল ৷
— আর
একঘন্টা পর মাঠে মিটিং শুরু হবে ৷ এই ভি আই পি-দের গাড়ি পাস করা শুরু হলো বলে ৷
ভজনের গলায় স্পষ্ট রাগ ধরা
পড়ছে,
ফাটা ফোঁড়ার অপমান ও নিতে পারছে না ৷ তাও আবার তার পাছা ৷
রিকশাচালকদের অনন্য অধিকার ৷
কুসুম আকাশের দিকে চোখ
কুঁচকে তাকায় , বলে,
— খুনখারাবি
আগুনে অাসমান, এই তে তে পুড়ে থাকা মাঠে জনতা বসবে কোথায়,
নিতে পারবে মন্ত্রীর ডায়লগ বলে মনে করিস! তা কোন রোড ধরে যাবে রে'
ওদের গাড়ি, পুলিশের গাড়িও থাকবে নারে, সাথে মিলেটারি ৷
— হুঁ তা তো
থাকবে, ভজন চুলকাতে চুলকাতে বলে যায়— তার
আগে রোড সাফ হবে...
— মানে,
ঝাঁটাবে নাকি মেথর দিয়ে!
— ধোর উদ্,
পাবলিক প্লেস নাহ্, রাস্তা দিয়ে এই তোর বাইক
চারচাকা ভ্যান মানুষ -জনদের সব সাইড করে পথ ফাঁকা করে দেবে ৷ পুরো শুনশান ৷ চেকিং
হবে রোড , বোম আছে কিনা, র্র্যাফ নামবে,
গগলস্ পরা আর্মি ঘুরবে ৷
এতক্ষণ কুসুম হাঁ করে
শুনছিলো,
এবার প্রশ্ন করে,
— তুই জানলি
কেমনে ৷
দাঁত বার করে ভজন নিজের ক্যালিবার
বোঝাতে পেরে এবার খুশ্, বলে — কাগজ পড়ে রে 'পাঁঠা, তুই তো ক অক্ষর গো মাংস , জানবি কোথায় ...
সাইরেনের আওয়াজ বেজে ওঠে
কোথায় কাছে ৷
— ভজন বলে
ওই যাচ্ছে শোন শালা, দেখ গিয়ে দূর থেকে সাঁট সাঁট করে সব
যাচ্ছে নেতারা, আর্মির পুলিশের জীপ ৷
কুসুমের ভাবান্তর হয় না, হেসে বলে —
আমরা তো সেফ, আমাদের তো সরতে হবে না ৷ এই পথ
দিয়ে ওরা গেলে এতক্ষণে পুলিশে পুলিশ ছেয়ে যেত নিশ্চয় !
— তা আর
বলতে, ভজন হাসে
সাইরেনের তীক্ষ্ণতা
সেকেন্ডে সেকেন্ডে বেড়ে চলেছে ৷ বোঝা যায় ভি আই পিদের গাড়ি আশে পাশের বড় রাস্তায়
...
লাঠিটা আঁকড়ে ওই ছায়ামধুর
পথে জুড়ানো রিকশার পা-দানিতে বসে পড়ে কুসুম
— তবে কি
বলিস আমার আর ওখানে পয়সা মাগা হলো না ৷ কে যাবে খুঁড়িয়ে অতদূর ৷ তারওপর তুই বলছিস
ধরে পিটবে ৷
— খুব বাজে
দিন আসছে রে কুসুম ৷ খুব
না-আচ্ছে দিন ৷ দেখছিস না
কেমন রক্ত বইছে চারদিকে ৷ শুধু মানুষ মরছে, দাম বাড়ছে, দেশ বেচছে ৷
— ধুশ্লা
দ্যাশ কী রে দ্যাশ! গেল ঝড়ে বস্তির আধেক ঘরের চাল ঝরে গেছে ৷ আমারটা উড়ে পড়েছে
পাশের খানায় ৷ সারাক্ষণ মাথার উপর হু হু আকাশ ৷ সকালটা জুড়ে যেন সূর্য গিলে খায় ৷
মূর্শিদকে দিয়ে কোনোরকমে ত্রিপল টাঙিয়ে মাথা ঢেকেছি ৷ বরষা হলে হরহরিয়ে জল ঢুকছে ৷
তাও নেওয়া যায় রে' হালকা পানি, গরম
রাতের হিম ,কিন্তু দিন'জোড়া ওই আলোর
তাপ , উফ্ ভজন, ভজন রে' গা সওয়া যায় না, মুখে রক্ত ওঠা বৌডার দানা পানি জোটে
না ঠিকমতন, আমি হইছি নুলো , খুঁড়িয়ে
মেরে এই জান কয়লা দিনে ভিক্ষে করি, আর বৌ সারাদিন মেঝেয় পরে
পুড়ছে, ওরে আল্লাহ্ রাত এলে মনে হয় তুমি কৃপা করেছো ,
শরীর জুড়িয়ে আমি আধ ন্যাংটা শুয়ে থাকি , বৌ
বুকের কাপড় সরিয়ে যেন কবরের ঘুম যায় ৷ কি আরাম কি আরাম সে সময়টুকুন, ফেরেস্তা নিজের চোখের পানি ঢেলে যেন দুজনের দুঃখ ঘোচায় ৷
পথের ছায়া যেন আরো খানি
শীতল হয়ে আসে এর মাঝে ৷ দুই শীর্ণ পরচ্ছায়ার আলাপ বুড়ো বট শিকড়ের মত গভীর আঁধারে
জল ঢুঁড়তে নামে ৷ ভজন বলে, — আর আমার ! আটান্ন বছর আগের বানভাসীর এই
রিক্সা আপাতত সব ৷ কেউ নেই কেউ নেই অবশিষ্ঠ এ'কূলে আর ৷ কিরে
কুসুম, তোর তো আছে তাও, বৌ আছে ,
চারপাশের তো চারটে দেওয়াল আছে, মাথায় না হয়
ইয়া উঁচু আকাশ তোদের চাল ! আর আমার ? মাছ আড়তের ডাস্টবিন,
ওরই পাশে মাদুর পেতে শুচ্ছি, শুধু একটা রাত
বরাদ্দ , কাক ভোরে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ৷ না বেরুলে চলে !
বরফ ঢোকে, মাছ ঢোকে, আঁশ গন্ধ চারদিক ,
ব্যবসা বসে যায় , জায়গা ছেড়ে পথে পথে থাকি সেই
সন্ধে রাত অবধি , ফিরে তাপ্পর নাকে মুখে গুঁজে ঘুম ৷ গরমে এই
কালাপানি রোদে আর সয় ! চলে আসি এ পথে, ছাওয়ায় মরার মতন থাকি
বরফে রাখা কই' মেরে ... তুই আসিস, গপ্প
হয় , সুখ দুঃখ , এই তো বেশ আছি না রে
কুসুম ৷ - গলা টাল খেতে খেতেও খায় না ভজনের , ফুসকুঁড়ির
ফাটার দ্বিগুণ অপমান সইতে হবে এই শালা কুসুমের সামনে কাঁদলে — গ্রীষ্মর দুপুরটা তো এখানেই বেশ ৷ ছাওয়া হাওয়া দুই দোস্ত জিরোই ৷ কই যাবো
আর কাঠফাটায়, সারা দিন ভিক্ষের পর এ যেন বড়লোকদের এয়ার
কন্ডিশনিং , হ্যা হ্যা ,কি বলিস ভজন
...
হঠাৎই যেন সাইরেন তেড়েফুড়ে
ওঠে ৷ বাঁক নিয়ে ছুটে আসে একটা লাল গাড়ি ৷ রিক্সার ধার দিয়ে ছুঁটে গিয়ে আরেক বাঁকে
অদৃশ্য হয়ে যায় ৷ দ্রুতমান বেগের স্পেশাল যানের ধারে ভজনের রিক্সা কেঁপে ওঠে ঝনঝন্
৷ আরো দুটো লালবাতি পুলিশ জীপ ছুটে যায় পেছন করে ৷ এরপর একটা কালো বোলেরো ৷ কিছু
বুঝে ওঠার আগেই সামনের টার্নের মুখ থেকে ছুটে আসতে দেখা যায় সাফারি পরিহিত
হাট্টাকাট্টা এক লোককে ৷ হাতে ওয়াকি-টকি , আরেক কানে ব্লু-টুথ হেডফোন
গোঁজা লোকটা এসে রিক্সা রুখে দাঁড়ায় ..
— এখানে কেন
৷ আবে চুপ রেহে কিঁউ ৷ ইহা মত রুখো ৷ চলো ইঁহাসে, বোক্চোদ ৷
মিনিস্টার যাবেন শালা এখানে দাঁড়িয়ে, আব্বে অ্যায় সুশীল
ডান্ডা লেকে আতো, কাহাকেঁ মাদারচোৎ লোগরে!
ভজন কুসুম দুজনেই বেধড়ক ভয়
পেয়ে গেছে, বুঝতে পারছে, জেড্ প্লাস ক্যাটেগরির
প্রধান মন্ত্রীর জার্নি রুট বদলেছে ৷এই খাঁড়ি ন্যায় সরু রাস্তা দিয়েই তাঁর গাড়ি
লোক লস্কর এখন সভামধ্যে যাবে ৷ গোলোমালটা বেঁধেছে এখানে ওদের দাঁড়ানো নিয়ে ৷
— হাঁ বাবু
আভি ভি চল যাতা হুঁ ৷ ডরানা মৎ বাবু ৷ হাম্ গরীব আদ্ ... কুসুমের দারিদ্র যেন
বোঝার অপেক্ষা নেই অফিসারের ৷ ঠাসানো চড় ওঠে হাতের ৷ টাল সামলাতে না পেরে মুখ
থুবড়ে পড়ে কুসুম ৷ ভজন ঝটপট কুসুমকে হাত ধরে টেনে ওঠায় ৷ পায়ের নকল ক্ষতর লাল তুলো
সরে গেছে ৷
—গুস্তাগি
মাফ্ করে দিন হুজুর ৷ ভজন হাত জোড়ে বলে,— আমরা দুজন ভিখারি
লোগ গরমে এই
পথের ছায়ায় জিরোচ্ছিলাম হুজুর , চলে যাচ্ছি চলে যাচ্ছি
এক্ষুণি অ্যাক্ষুণি— ওয় কুসুম ওঠ রে ওঠ শালা রিক্সাটাতে ওঠ
শালা তাত্তাড়ি ৷ তর্ক করছিস যে শালা ....!
সেবাময় আশ্রম রোডের দু
প্রান্তের পাঁচিলের ছায়া আরো ঘন হয়ে ওঠে ৷ কোয়ার্টার বিল্ডিংগুলো আরো হেলে পড়ে
কুচোকুচো রোদের বুকে৷ কুসুমকে রিক্সায় টেনে নিয়ে ভজন এগিয়ে চলেছে ৷ ওরা চলে যাচ্ছে
৷ পাঁজরের মতন বাঁকা আলোরুদ্ধ ঠান্ডা বাড়ি আর দেওয়ালের প্রতিবিম্ব গায়ে মুছে নিয়ে
ভজন আর কুসুম দৃপ্ত রোদের কাছে ফিরে যাচ্ছে…
আরও পরিসর দাবি করে এই গল্প।
ReplyDeleteলেখক আরো ভাবুন। গল্পকে সময় দিন।
ReplyDelete