অনুপম : এবার তাহলে সংহত কবিতা নিয়ে কথা হোক। যেমন মৃত শিশুর ব্যবহৃত খেলনা বা ফিডিং বটল কেউ
কেউ পুঁতে দিয়ে আসে সুখী লোকেদের বাগানে, যাতে তাদের সুখ নষ্ট হয়, কবির সেই কাজ
নিয়ে কথা হোক, যা অলক্ষিত, এবং যা পাঠকের অরক্ষিত প্রদেশের সংবাদ রাখে।
অমিতাভ মৈত্র : এই বিষয়ের অবতারণা করলে অনুপম, আর আমার মনে পড়ে গেল মঞ্জুষ
দাশগুপ্তের এই কবিতা –
শব্দ তুমি হাত ধরো মৃত্যুর
নিঃসঙ্গতার
রক্তাক্ত হৃদয়ের
এবং
অসহায়তার...
কবিতাটি যেন স্তোত্রের মতো, মন্ত্রোচ্চারণের মতো শুরু হয়। এরকমের অলৌকিক আভা ও
মহানতা আছে শব্দ গুলো সাজিয়ে দেওয়ার মধ্যে। কাটা কাটা ভাবে শব্দরা এসেছে, অমোঘ হয়ে
এসেছে। ‘শব্দ’ – যা কবির প্রধানতম যন্ত্র – তাকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা যুগে যুগে লিখে
গেছেন কবিরা। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সুনীলের – না ‘জাটিংগা’ আর ‘হারাঙ্গাজাও’ এই
দুটি রেল স্টেশনের নাম থেকে উঠে আসা কবিতাটি নয় – বরং এই কবিতাটি।
শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে
দেখাবে বলেছিল
শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল
গোপনে
শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল
কবিতাটির
টান চুম্বকের মতো, প্রতিটি স্তবক তিন লাইনের, লাইনগুলো বারবার ফিরিয়ে এনে সুনীল
যেন সম্মোহিত করে দেন পাঠককে।
মঞ্জুষ দাশগুপ্ত এই চমৎকার ভাবে শুরু হওয়া
কবিতাটি এর পরে মাঝে মাঝেই টলে যায় আর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কবিতাটি –
মরে যেতে চাই আমি
কালিন্দীর কুলে
মরি লো মরি আমায়
বাঁশিতে ডেকেছে সে
-তে এসে শেষ হয়ে যায়। মঞ্জুষ দাশগুপ্তের মতো প্রকৃত শক্তিমান একজন কবি, অনেক
আগেই শেষ হয়ে যাওয়া কবিতাটিকে দুঃখজনক একটি অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। তার কবিতা
বিষয়ে ধারণার ছক তাঁকে অপ্রয়োজনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
চাকরি
সূত্রে যখন আমি জলপাইগুড়িতে তখন আলাপ হয় প্রবীর রায়ের সাথে, ষোলো বছর আগের কথা
বলছি। বাংলোর গেট থেকে দুদিকে গাছের সারি দিয়ে রাস্তাটা এগিয়ে চলে। রাত্রি সাড়ে
আটটা প্রায়। হেডলাইটের আলোয় দেখছি বারান্দার চেয়ারে একজন আত্মনিমজ্জিত মানুষ শূন্য
দৃষ্টি সামনে মেলে বসে। হঠাৎ মনে হল
চেয়ারের মানুষটি কই আমিই! তাহলে গাড়ির মধ্যে এই আমিটি কে? একটি সঠিক যুক্তি এসে
আমার ভুল ভেঙে দেয়। আমি বুঝতে পারি আমার মতো চঞ্চল মানুষ অমন আত্মস্থ সন্ন্যাসী
হতে পারবে না কখনও। তখন উনি বিদ্যুৎ দপ্তরের ডিভিশানাল ইঞ্জিনিয়ার। ‘মুক্তাভবন’
নামের একটি বাড়ি বিষয়ে যৎসামান্য কথাবার্তার মধ্যেই আমি আকৃষ্ট হলাম ওর প্রসন্ন,
সম্বিত, বেপরোয়া মুখটি দেখে। প্রায় শিহরিত হলাম যখন জানলাম “বরফ” মানের
কাব্যগ্রন্থটি, যা পনেরো কুড়ি বছর আগে বাঁকিয়ে দিয়েছিল আমাকে, সেটি ওর লেখা। এরপর
আমি যন্ত্র চালিতের মতো অবিশ্বাস্য একটি কথা নিচু গলায় নিজেকেই বলতে শুনলাম ওর
উদ্দেশ্যে – “ আজ রাতে এখানে থেকে যাবেন – সারা রাত আড্ডা দিতে”
আমরা সবাই ওঁর কবিতা বারবার
পড়েছি। দশ বছর পর আমি অন্য কাজে জলপাইগুড়িতে মাঝে মাঝে যেতাম। তখন ওঁর পর্ণকুটিরের
মতো সুন্দর আর পোষা বেড়ালে সাজানো বাড়িটিতে রবিবারের আড্ডায় গেছি । “শ্যামল ছায়া”
কি সুন্দর নাম!
অনুপম – হ্যাঁ, প্রবীর
রায়ের কবিতা আমারও ভাল লাগে। ওঁর ‘কাচঘর’ নামক একটি কবিতার বই উনি আমাকে দিয়েছিলেন। সংহত কবিতায় ওঁর দখল প্রচুর। একটা কবিতা কোথায়
থেমে গিয়ে পরের কবিতার জন্য রাস্তা খুলে দ্যায়, অথবা পরের কবিতার অপেক্ষাটি শুরু
হয়ে যায়, একজন কবির সেটা জানা উচিত। প্রবীর সেটা জানেন, খুব ভালভাবে। শ্যামলছায়ায়
তরুণদের আড্ডার খবরও ফেসবুকে দেখতে পাই নিয়মিত। প্রবীর কবিতা নিয়েই বেঁচে আছেন,
তরুণদেরও জড়িয়ে থাকতে চাইছেন। গুরুগিরি করার চেষ্টা অথচ চোখে পড়ে না।
অমিতাভ – প্রবীরের মতো কবির
সাথে আমার বন্ধুত্ব আছে, এটা একটা দারুণ ব্যাপার। প্রবীর আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি।
ওঁর কবিতা নিয়ে আমার মুগ্ধতার কথা অনেক আগে অতনুর পত্রিকায় জানিয়েছিলাম। সময়ের
সাথে সাথে সেই আকর্ষণ আরো গভীর হয়েছে ।
প্রবীর এবং আরো কারো কারো কবিতা
পড়ার সময় একটা অনুভূতি হয় যে নূন্যতম শব্দের মধ্যে সংকেত মিশিয়ে দেবেন কবি, বাতাসে
দূর থেকে সহসা ভেসে আসা সুরের মতো এই কবিতা চৈতন্য সজাগ রেখে পড়তে হবে।
অনুপম – আপনি কি এখন জেন
নিয়ে মেতেছেন? টারজানের জেন নয়। জেন কবিতা, জেন গল্প... ঘাটালে থাকাকালীন আপনার
টেবিলে বীতশোক ভট্টাচার্যের এ-বিষয়ক একটা বই দেখেছিলাম। কথাবার্তা শুনে মনে
হচ্ছে... সেই “সাটোরি”...
অমিতাভ – ঠিক ‘সাটোরি’। এক
ধরনের উদ্ভাসন। কিন্তু ‘কোআন’ নয়। কোআন অনেকটাই বীজ মন্ত্রের মতো, জপে ডুবে যেতে
হয় যার মাধ্যমে।
অনুপম – কবিতাটা ?
অমিতাভ – একটা শীর্ণ পত্রিকার হলুদ রঙের
পাতায় ছিল কবিতাটি “অন্যকাতরতা” কবিতাটার নাম।
ভেড়াটার সামনে
দাঁড়িয়ে আছে লাল গেট।
ভেড়াটার মধ্যে দিয়ে সবুজ ঘাসের
রাস্তা।
ঘাস পেরিয়ে উলের
বাগান...
শীতের এই চুপচাপকে ডিঙোতে পারছেনা
লাল গেট
‘লাল গেট’ এর জন্যই
সম্ভবত এর জন্যই অবাধ অনুষঙ্গে আমার প্রথমেই মনে পড়েছিল উইলিয়াম কার্লোস
উইলিয়ামসের ‘লাল ঠেলাগাড়ি’ কবিতার কথা। দুটো কবিতাতেই অবশ্যম্ভাবী আর একই সাথে না
বলা সত্যের মতো একটা ঝকঝকে সকাল রয়ে গেছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে লাল রঙের একটা গেট। পথ
আটকে দিচ্ছে একটা চুপচাপ ভেড়াকে। চমৎকার সবুজ ঘাসের রাস্তা প্রস্তুত হয়ে আছে ভেড়ার
জন্য। ঘাসের অন্যপ্রান্তে।
একটি বিস্ময়কর চিত্রকল্প এনেছেন প্রবীর ‘উলের বাগান’ গেট
পেরোতে না পারা ভেড়ার সাথে উলের বাগান মিলে কীভাবে যে ধবংস করে দেয় পাঠককে! এই
হচ্ছে কবির শব্দ।
একটি সকালের শুদ্ধ শান্ত
মূর্তিকে ভেঙে দিতে পারছেনা লাল গেট। ভেড়া ও লাল গেটের মাঝপথে একটা শীতের সকালের
হিম নিঃশব্দ। দুজনের কেউই যেটা ভাবতে পারছে না। চার লাইনের কবিতার মধ্যে কতো পরত,
কতো রঙের আলো! কতো নির্ভার! কতো গভীর! কতো অন্তরস্পর্শী
অনুপম – হ্যাঁ। অনেকগুলো
পরত। ‘The Red Wheel barrow’ র কথা বলছেন,
সেখানে কয়েকটা শব্দে একটা লাল ঠেলাগাড়ির বৃষ্টির জলে ধুয়ে ক্রমশ চকচকে হয়ে ওঠার
ছবি এঁকে ছিলেন উইলিয়ামস। চোখের সামনে যেন বৃষ্টির জলে চকচকে হয়ে ওঠা একটা লাল
ঠেলাগাড়িকে দেখতে পায় পাঠক, যখন কবিতাটা পড়ে। আমার প্রিয় কবিতা। আপনার মুখে ওটার উল্লেখে ভাল
লাগছে। - এইটুকুই তো কবিতা! কবিতার কাছেও এইটুকুই তো আমরা চাই।
অমিতাভ – ‘জাগরণ হেমবর্ণ’ তোমার জাগরণ জাগিয়ে
দিল আমাকেও। এখন কবিতাটা খুঁজে বের করতেই হবে। পড়তেই হবে। এক মিনিট আমি খুঁজে নিয়ে আসছি।
অনুপম – এই যেটা আপনি এই
মুহূর্তে করছেন এবং যা আমরা সবাই বারবার করে যাই, এই যুক্তিহীন উন্মাদনা- একটা
কিছুর জন্য তৃষ্ণা, অতৃপ্তি- আমরা যারা কবিতা পাগল তারাই বুঝি। একটা ভেঙে পড়া
লাইন, অথবা, একটা লাইন যার ভাঙার কথা ছিল আমারই হাতে, হারিয়ে যাওয়া কোন বইয়ের
পাতা, কিংবা, তাকে হারিয়ে যেতে দিয়েছি আমিই, বাতাসে ভেসে যাওয়া কোনো শব্দ...
অমিতাভ – হা হা পাগল হতে হলনা এবার অনুপম!
পেয়ে গেছি কবিতাটা।
কতো কী নির্ভর করে।
সাদা মুরগীর পাশে
বৃষ্টিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা কোনো
লাল ঠেলাগাড়ির ওপর
অনুপম – So much
depends/upon/ a red wheel/ … একটামাত্র কেজো ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট
ধরণে বলে যাওয়া বাক্য- এবং সেখানেই কবিতাটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। “So much
depends upon” যেন রাস্তায় কথা বলতে বলতে হেঁটে যাওয়া কোনো মানুষের
কথা আংশিক কানে ভেসে এল। এবং, এই কবিতাটা, তাই, কোনোদিন শেষই হয় না।
অমিতাভ – হ্যাঁ। দ্যাখো,
প্রথমে যে চাকাওয়ালা ঠেলাগাড়ির ব্যাবহারিক উপযোগিতার কথা এলো So much depends এর সাথে। ঠিক তার পরের লাইনেই সেই লাল ঠেলাগাড়ি
বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধীরে ধীরে যেন সম্পূর্ণ অন্য কিছু হয়ে উঠছে। ছাপিয়ে যাচ্ছে তার
অস্তিত্বকেও। কোনোকিছুই যেন আর নির্ভর করে না তার ওপর। কলম ছেড়ে কবি যেন রং তুলি
তুলে নিচ্ছে এবার, শব্দকে ছেড়ে।
বলালম শব্দকে ছেড়ে। কিন্তু শব্দের ভিতরে যে বর্ণমালা, বর্ণ
বা রঙ থেকে সত্যিই কি বিযুক্ত সে হতে পারে কখনও? শব্দের মধ্যে ধ্বনির এই রঙ আছে। “Wheel barrow এবং rain water কে দু লাইনে
ভেঙে দিচ্ছেন কবি, যেন কবিতাটির প্রধান ইমেজ হয়ে যে দুটো শব্দ এল, উইলিয়াম যেন মৌল
খন্ডাংশে তাদের যাচাই করে নিচ্ছেন জলের ধারা যেভাবে স্তরে স্তরে চকচকে করে তুলছে
লাল ঠেলাগাড়িকে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে একটা ফ্রেশ লুক যেন এসে যাচ্ছে কবিতাটির মধ্যেও।
কবিতাটির ফর্ম আর মিনিং যেন গ্লে মিশে এক অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠছে। আলাদা করা যাচ্ছেনা
কাউকেই আর।
একটু আগে প্রবীরের যে কবিতাটি
পড়ছিলাম সেটিও যেন উইলিয়ামসের কবিতার মতোই শব্দে আঁকা স্টীল লাইফ। দুটি কবিতাই
স্থির। দাঁড়িয়ে থাকা লাল ঠেলাগাড়ি আর দাঁড়িয়ে থাকা লাল গেট, এর ভারসাম্য রয়েছে
স্থির সাদা মুরগী আর সবুজ ঘাসের রাস্তা। দুটি কবিতারই Key word এই ‘লাল’ শব্দটি।
তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম, তাই লাল রঙের ইনটেন সিটি সব থেকে বেশি।
দুটি কবিতাতেই তার ইনটেন সিটি সব থেকে বেশি। দুটি কবিত্যাতেই তার উপস্থিতি
নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য সব কিছু- অপারেশন থিয়েটারের দরজায় লাল আলো যেভাবে নিয়ন্ত্রণ
করে চারপাশের পরিবেশকে।
অনুপম – ব্রুস লি যেন এসে দাঁড়ালেন
তাঁর প্রতিপক্ষের সামনে, যেখানে কোনো প্রতিপক্ষ নেই, কারণ সেখানে কোনো ‘আমি’-ই
নেই।
অমিতাভ – খুব ভালো বলেছ!
দুটো কবিতাই যেন তথাকথিত বলাকে তাচ্ছিল্ল্য করে দেখাচ্ছে কি সে করছে আসলে। কিছু
‘বলা’ যদি অভীষ্ট হতো তাঁর এই কবিতার – মাত্র চৌদ্দটি শব্দ আছে যেখানে- তাহলে
উইলিয়ামস প্রতিটি শব্দকেই কাঞ্চন তোলে ( সোনার নিক্তিতে) যাচাই করে চূড়ান্ত অর্থবহ
করে তবেই কবিতায় আনতেন। ঠিক তার উল্টোটা করলেন উইলিয়ামস।
অনুপম – বলে যান। ভাল লাগছে।
অমিতাভ – কবিতাটির একেবারে
প্রথম চারটি শব্দ “So much depends/ upon” যার ওপর কোথাও কোন কিছুই নির্ভর করছেনা। কি নির্ভর করে, কেন আর কিভাবে
নির্ভর করে- এসব নিয়ে একটি শব্দও কবিতায় এল না । লাল রঙের একটা ঠেলা গাড়ি বৃষ্টিতে
ধুয়ে চকচক করে ওঠার ওপর কোথাও কিছু নির্ভর করেনা। এটা কিন্তু কবি কোথাও বলছেন না।
আবার একই সাথে ব্যাপারটা অস্বীকারও করছেন না তিনি। স্রেফ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন আর
তাঁর অন্যমনস্কতার মধ্যে লাল একটা ঠেলা গাড়ি বৃষ্টির জলে চকচকে হয়ে উঠছে ক্রমশ।
‘লাল গেট’ কবিতায় প্রবীরের যাওয়াটা আবার অন্যরকম। ভেড়া
চুপচাপ দাঁড়িয়ে। এগিয়ে যাচ্ছেন। লাল গেট যেন নিজেই চাইছে ভেড়াটির দিকে এগিয়ে যেতে,
কবিতাটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইন একটি অসামান্য পরাবাস্তবতার ছবি হয়ে উঠছে যেন। তবে
এসবের অনেক বাইরে যা নিঃশব্দে মুখ লুকিয়ে আছে কবিতাটির মধ্যে – তা একটি শীত ও একটি
দ্বিধা যা একই সাথে দাঁড় করিয়ে রেখেছে একটি ভেড়া ও একটি লাল গেটকে। ভাবা যায় না,
না?
এই ধরণের কবিতা পড়লে মনে হয়
চমৎকার ভাবে হিরে বসানো কোনো কঙ্কাল। নান্দনিক মূল্য অসামান্য, কিন্তু জীবনটাই নেই। প্রবাহিত জলে আঙুল ছোঁয়ানোর সময় যদি না বুঝতে পারি আমার আঙুল চলে যাওয়া কোষ আর
এগিয়ে আসা জলের প্রথম মুহূর্তটির সন্ধি জলের ছুঁয়ে আছি। আমি বলতে পারব না আঙুলের দেখায় পূর্ণতা আছে। একটু আগে পড়া "লাল ঠেলাগাড়ি" কবিতার কথা একটু আসুক না হয়-কি বলো? উইলিয়ামের কবিতা আজ মনে হচ্ছে একটু জ্বালাবে আমাকে।
জল ছুঁয়ে আমার আঙুলের যা
বোঝা হলোনা- ভেঙে সেই প্রবাহের সবটুকু বুঝে নেওয়া-wheel borrow আর rain water শব্দদুটিকে টুকরো করে
বিশ্লেষণ করে, বুঝে তারপর আবার তাদের পূর্ণতায় ফিরিয়ে
দেওয়ার মাধ্যমে উইলিয়ামস কিন্তু সেটা করেছেন। প্রবীর একটি
দ্বিধায় মোড়া লালগেট আর ভেড়ার মধ্যে সেই মুহূর্তকেই ধরতে চেয়েছেন। টেবিলের ওপরে জ্বলজ্বল করতে থাকা টমেটো আর একটি প্রশ্নের মধ্যে কবি শ্যামল
সিংহ, ঘটনাক্রমে তিনিও জলপাইগুড়ি শহরে থাকতেন, মুহূর্ত ও বিস্ময়েরর এই অপরূপকে ধরেছেন।
অনুপম- আমি জানি আপনি কী বলতে চাইছেন এখন। শ্যামল সিংহ। এবার এই নামটা অনিবার্য। আর এই কবিতাটা-
টেবিলের ওপর জ্বলজ্বল করছে টমেটো
তুমি কি বিবাহিত?
টেবিলের ওপর জ্বলজ্বল করছে টমেটো
তুমি কি বিবাহিত?
টেবিলের ওপর জ্বলজ্বল করছে টমেটো
তুমি কি বিবাহিত?
অমিতাভ- শ্যামল সিংহর কবিতা কনজিওরিং ম্যাজিকের মতো। কোনো নতুন শব্দ দিয়ে চোখ ধাঁধানোর চেষ্টা নেই। জড়োয়া গয়নার মতো ভারী তৎসম শব্দ দিয়ে তুচ্ছ, ফালতু অনুভূতিকে মহিমাযুক্ত করে দেখানোর চেষ্টা নেই। সাধারণ, ফ্ল্যাট ভাষা কোথাও কোনো লুকোনো তাস নেই। অপ্রত্যাশিত ভাবে জুড়ে যাওয়া দুটোলাইন-উন্মাদ কল্পনাতেও যাদের একত্র করার কথা ভাবতে পারবে না কেউ-বিস্ময়ে চোয়াল বুলিয়ে দিয়েছিল আমার। আমার যৎসামান্য কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতায় এমন "সিক্রেট মিরাকল" আগে কখনও দেখিনি।
অনুপম- "সূর্যাস্ত আঁকা নিষেধ" বইটাতে এই কবিতা আছে। ওঁর নির্বাচিত কবিতাও বেরিয়েছে কয়েকবছর আগে।
অমিতাভ- গোটা কবিতাটি দাঁড়িয়ে আছে যৎসামান্য একটি প্রশ্নের ওপর। স্রেফ দুবার প্রশ্নটি এসেছে - একটু থেমে,একটু অপেক্ষা করে।মাঝের স্পেসটুকু যেন চিন্তা করছে। দ্বিতীয়বার প্রশ্নটি তোলায় আগে আরেকবার চিন্তা করে নিচ্ছে।সাধারণ আর ছোট্ট একটা প্রশ্ন স্থির বলে একটু যেন শিহর তুলে মিলিয়ে গেল আবার।
প্রথম লাইনটি একটি সম্পূর্ণ পরাবাস্তব ছবি হয়ে সামনে এল। টেবিলের ওপর জ্বলজ্বল করছে টমেটো। টমেটোর পাশে জ্বলজ্বল শব্দটি যেন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয় মাথার ভেতরে। দৃষ্টিতে উজ্বল হয়ে ওঠা লাল ঠেলাগাড়ি,একটি সকালের শান্ত রূপের সামনে দ্বিধা নিয়ে চুপ করে থাকা লাল গেট এর মতোই জ্বলজ্বল করে ওঠা এই টমেটোকেও কবিতা যেন অন্যএক জীবনের গল্পে নিয়ে যায়।বৃষ্টির জলে ঠেলাগাড়িটি যে glaze পায়,নিজের ভিতরের আলোয় সেভাবে জ্বলজ্বল করে ওঠে টমেটো। উজ্জ্বলতার উৎস বাইরে।আলো,ছায়া আর রঙের ওপর নির্ভর করে সে কি উজ্জ্বল,না নিষ্প্রভ ম্লান সে।কিন্তু জ্বলজ্বল করে তুলতে পারে একমাত্র সেই প্রাণ।বস্তুর ভেতর থেকে আসা উদ্ভাসন,ইলিউমিনেশন। ব্লেকের "Tiger" কবিতায় রাত্রির ঘনান্ধকারে জ্বলজ্বল করে ওঠা বাঘ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় "পুরনো সিন্দুকে যেন লুকোনো গিনির মতো ঝলসে উঠল মুখ" এর ইলিউমিনেশন থেকে শ্যামল সিংহর "টমেটো" কিন্তু খুব পিছিয়ে নেই।
অনুপম- পিছিয়ে থাকার কথাও ছিল না। জলপাইগুড়ি থেকে আপনি ঘাটালে বদলি হয়ে এসেছিলেন যখন, অনেক কিছুর সাথে শ্যামল সিংহর এই বইটাও ছিল আপনার সাথে। আমরা এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় ভাবছিলাম, কোন অলৌকিকে "তুমি কি বিবাহিত" এসে পড়ল দ্বিতীয় লাইনে, দূরতম কল্পনাতেও যে এসে পড়ার ধারনা পর্যন্ত করা যায় না!
অমিতাভ- আমার সারাজীবনের বিস্ময় হয়ে থাকবে এই অসম্ভব কবিতাটি। কবিতার জড়োয়া গহনার শিল্পীরা এই অবিশ্বাস্যকে ধরতে পারবেন না কখনও।ভিন্ন সময়ের পড়ায়।আপাতত একটা ছবিই বলি। -নির্জন নিরালা একটা সন্ধ্যার টেবিল। মুখোমুখি বসে একজোড়া নারীপুরুষ। রঙীন সুদৃশ্য মোমবাতি জ্বলছে। সামান্য কিছু কথা আর অনেক দ্বিধা থরোথরো না-কথা মিলে এক বলয় ঘন হয়ে উঠছে দু’জন সম্মোহিত নারী পুরুষের মধ্যে। তাদের না-বলা কথাটি উন্মুখ হয়ে জ্বলজ্বল করছে। তাদের এই বিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মোমবাতিটিও যেন আপক্ক রক্তিম টমেটোর মতো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, সেনসুয়াস হয়ে উঠেছে।
অনেকদিন আগে একটা ছবি
দেখেছিলাম-বিকাশ ভট্টাচার্যর আঁকা। একজন ভারী চেহারার টসটসে পুরন্ত মুখের নারী বঁটিতে টমেটো কাটছেন, ছবিটি প্রায় ফটোগ্রাফির মতো বাস্তবানুগ। বঁটি থেকে যে রস
গড়িয়ে নামছে সেটা কিন্তু অনেক বেশি লাল। সেই স্রোত যেন
অন্যকিছু হয়ে উঠেছে। নারীর চোখেও ছড়িয়ে পড়েছে এই গাঢ় লাল রঙ। টমেটো যেন টমেটোর বাইরের কোনো একটা অস্তিত্ব। ছবিটিতে ইভিল রিপোর্ট আছে একভাবে। ভয় আছে।
অনুপম- এই কবিতাটা পড়ুন। দেখুন, কী অদ্ভুত! “হাওয়া দূরে গেলে মহিষ/মহিষ দূরে গেলে হাওয়া।“ আরেকটা কবিতাও অসাধারণ। ওঁর যে কবিতাটা নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম এতক্ষণ, তার আত্মীয় যেন এই কবিতা- “আত্মহত্যার আগে উঁকি দেয় টমেটো/আত্মহত্যার পরেও উঁকি দেয় টমেটো”। কবিতার নাম “টমেটো”। শ্যামল সিংহর কবিতায় নামকরণ সাদামাটা, কবিতায় কোনো চমক নেই। কিন্তু, মোক্ষম মুহূর্তে পাঠকের বুকে অব্যর্থ বিঁধে যায়!
অনুপম- এই কবিতাটা পড়ুন। দেখুন, কী অদ্ভুত! “হাওয়া দূরে গেলে মহিষ/মহিষ দূরে গেলে হাওয়া।“ আরেকটা কবিতাও অসাধারণ। ওঁর যে কবিতাটা নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম এতক্ষণ, তার আত্মীয় যেন এই কবিতা- “আত্মহত্যার আগে উঁকি দেয় টমেটো/আত্মহত্যার পরেও উঁকি দেয় টমেটো”। কবিতার নাম “টমেটো”। শ্যামল সিংহর কবিতায় নামকরণ সাদামাটা, কবিতায় কোনো চমক নেই। কিন্তু, মোক্ষম মুহূর্তে পাঠকের বুকে অব্যর্থ বিঁধে যায়!
অমিতাভ- একদমই তাই। বাক্ সংযমের শিক্ষা দেয় যেন তাঁর কবিতা। যেসব কবিতা এতক্ষণ ধরে পড়লাম-একটা কোনো দর্শনের ছায়া যেন তাদের মধ্যে। মুক্তির একটা জায়গা, দেখার একটা নিজস্ব চোখ আছে কবিতা আছে কবিতাগুলোর মধ্যে। কবিতাগুলোর আবেদন সরল, তাদের অন্তর্বয়নে কোথাও জটিলতা নেই। স্বতঃস্ফূর্ত, প্রশান্ত এক সদ্য জেগে ওঠা সকালের অনুভূতি যেন জড়িয়ে আছে।একটা জেন গল্প বলি,অনুপম? খুব অপ্রাসঙ্গিক হবেনা মনে হয় গল্পটা।
দুজন বৌদ্ধ
ভিক্ষু দূরের, একটা মঠ এ যাবেন বলে বেরিয়েছেন। একজায়গায় এসে তাঁরা দেখলেন যে
নদী তাঁরা হেঁটেই পার হয়ে যান, প্রবল বৃষ্টির পরে আজ ফুলে
ফেঁপে উঠেছে সে। পার হওয়াই
কঠিন।
নদীর ওপারে
সুন্দরী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। একজন ভিক্ষু
তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কি জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি বলল,জল
এতো বেড়ে গেছে, এরমধ্যে কিভাবে সে ওপারে যাবে
বুঝতে পারছেনা।
“আরে! এটা
কোনো সমস্যা নাকি! আমি আপনাকে তুলে ওপারে নামিয়ে
দিচ্ছি এখুনি। আসুন।“
মেয়েটিকে
পৌঁছে দিয়ে ওঁরা দুজন হাঁটতে শুরু করলেন। দু’তিন
ঘন্টা পার হয়ে গেছে। মেয়েটিকে যিনি
সাহায্য করেছেন তিনি মাঝে মাঝে কথা বলছেন সঙ্গী ভিক্ষুর সাথে। কিন্তু সঙ্গী নিরুত্তর। তাঁর মুখ থমথম করছে। মঠে পৌঁছে তিনি ভৎর্সনা করে
বললেন- “আপনার
মনে রাখা উচিত আমরা ভিক্ষু। কোনো নারীকে
স্পর্শ করা আমাদের নিষেধ। ঐ নারীকে বহন
করে আপনি গর্হিত অন্যায় করেছেন। “আমূল
বিস্মিত হয়ে অন্যজন তখন বললেন- আমি তো দুয়েক
মিনিট বহন করেই তাঁকে নামিয়ে দিয়েছি। আর এই তিনঘন্টা আপনি তাকে বহন
করে যাচ্ছেন!
অনুপম – (হাসি) হ্যাঁ, এটা তো খুব বিখ্যাত জেন গল্প। বীতশোক ভট্টাচার্য অনুবাদ করেছেন সুন্দর। আমি কোনো নারীর প্রতি আকৃষ্ট হলে এই গল্পটা ভাবি, নিজে টারজান আর তাকে জেন বানানো সোজা হয়ে যায়।
অমিতাভ – আমাদের কবিতার ক্ষেত্রেও এই গল্পটা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ঐতিহ্য ও প্রথার প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্যের সাথে যখন কৃত্রিম কন্ঠস্বর জুড়ে সুলিখিত কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ হই আমরা তখন সেই কবিতাকে মনে হতেই পারে দামি কোম্পনির টিনে বন্দী একদম তৈরি খাবারের মতো - মাইক্রো ওভেনে একটু গরম করলেই চমৎকার!
"হে প্রগাঢ় অনুপম, আজও চমৎকার!"
(ক্রমশঃ)
আমি আজ অব্দি যে গুটিকয় সাক্ষাৎকার পড়েছি, এটা তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। শুধু নিজের কথা, নিজের লেখালেখির কথা নয়, যে দু'জন মানুষ এখানে কথা বলছেন তাঁরা এত জায়গা ছুঁয়ে আসছেন, সাক্ষাৎকার হিসেবে যেটা খুব ইউনিক।
ReplyDeleteonek kichhu jante parlam...khub guruttopurno sakkhatkar eti
ReplyDelete