।। যে ছবির মালা পুরনো হবার নয় ।। অভিরূপ মিত্র ।।






যে ছবির মালা পুরনো হবার নয়
অভিরূপ মিত্র

পূর্বসূত্রবিহীন পাঠক একটা বই যখন তুলে নেন হাতে তখন প্রথম যে ইন্দ্রিয় সাড়া দেয় তার নাম ত্বক। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, চামড়া। হার্ডকভার বাইন্ডিং। তার জ্যাকেট। মসৃণ। একটা কাঙ্ক্ষিত আরাম করতলগত হওয়ার পর জেগে উঠতে চায় মন। এরপর রসিক যে জন তিনি নিতেই পারেন একটু নিবিড় ঘ্রাণ।
      এই যে কাছে এগিয়ে আসা, একান্ত সংযোগের জন্য, এর শুরুতে তো ছিল চোখের ডাক। সচেতন বিপণির ডিসপ্লে বোর্ড, অথবা মেলার র‍্যাকে দৃশ্যমান শুধু শিরদাঁড়া, এইটার ছবি মস্তিষ্কে যাওয়া মাত্রই পৌঁছে গেছে হাত। ঠিকই এসব ব্যাপারে লেখকের কারিকুরি নেই বিশেষ। এটি প্রকাশনার অঙ্গ। প্রথম দর্শনেই ভালবাসার বোধ জাগিয়ে ‘হাওয়াকল’ সার্থক এক্ষেত্রে। উপরে যা যা বলা হল তার সব অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যেতেই পারেন—আবার বলি, অনাঘ্রাত পাঠক, যদি হঠাৎই দেখতে পান ‘পুরনো দিনের ছবি’।
      ব্লার্ব জানাচ্ছে আবেশ কুমার দাসের গল্প ঐতিহ্য বহন করে আনে প্রজন্মান্তরে। শিকড়সন্ধানী লেখক তাঁর ভূমিকায় স্বীকার করেই নিয়েছেন বনেদিয়ানার প্রতি তাঁর মোহগ্রস্ততার কথা। এ বিষয়ে কৃতজ্ঞ তিনি প্রয়াত সাহিত্যিক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা বনেদি কলকাতার ওপর গবেষণার জন্য। মোবাইল কম্যুনিকেশন অ্যান্ড নেটওয়ার্ক টেকনোলজিতে এম. টেক এবং পেশায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপকের লেখনী অচেনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে এবং বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে আন্তর্সম্পর্কের জালকে চিনিয়েছে অনুভূতিশীল দক্ষতায়। নির্মাণের দক্ষতায় ‘চেনা মানুষের অচেনা জীবন’ উঠে এসেছে কাহিনির শরীরে।
      বডি শেমিং পরিশীলিত আলাপচারিতায় অপাংক্তেয়। ঋষভ অধিকারীর আত্মপরিচয় গড়ে তোলার সংকটের মূলে আছে আবলুশ কাঠের মতো তার গায়ের রং। ভিন্ন কোণ থেকে দেখলে, শিকড়ের অনপনেয়তা স-ফল বৃক্ষকে মনে করিয়ে দেয় আলোর বিপরীতগামী সোঁদা গন্ধের কথা (আবলুশ)। দ্বিতীয় গল্পটি পড়ে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বার্নার্ড শ’এর অতিমানবীসুলভ চরিত্রের দ্বারা ধোপার পাটে আছাড় খেয়ে, বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে চাওয়ায় চুরমুর হয়ে যাওয়া স্বপ্নের রং তুঁতে?
      কবির যন্ত্রণায় লেখক সমব্যথী। লিখন যদি হয় সাধনা তবে সিদ্ধিলাভের জন্য চাই কাঙ্ক্ষিত সাধনকক্ষ। কিন্তু তা যখন বস্তুগত কারণে থেকে যায় সাধ্যাতীত? অনর্জিত দেড়তলায় শিলীভূত উচ্চাকাঙ্ক্ষা কবিকে দেয় যে আত্মতৃপ্তির স্থবিরতা, তার থেকে উদ্ধার পেতে বদলে যায় কবিতার স্বদেশ (দেড়তলার ঘর)। অর্থগৃধ্নু জড়জগতে অপরাহত খারাপকে অতিবাস্তবতার ছোঁয়া দিয়ে মুছে দেওয়ার পৌরাণিক প্রয়াস আছে নামগল্পটিতে।
      পরের গল্পে ছায়াহীন শূন্যতাহীন অদ্ভুত নিঃস্বতাবোধের কারণ নিজের জৈব শরীরের একধরনের সীমাবদ্ধতা। আর তাকে দূর করার আচমকা আহ্বান হাতে ধরিয়ে নিরালম্ব নগ্নতায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে যায় বেইজ্জত বাণিজ্য (লিফলেট)। এ এক এমন সময় যখন নিরাপদে বাঁচতে গেলে বিপরীতমুখী বিবর্তন কার্যকরী পথ। অভ্যাস করতে হয় সরীসৃপ নমনীয়তা। কারণ তা মানবিক ঋজুতার চেয়ে অনেক বেশি ঘাতসহ (বুকে হাঁটা)।
      অন্ধকারে বসে থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে যায় অন্ধকার। তারপর অভ্যাসের জড়ত্ব আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আপাদমস্তক। আকর্ষ বাড়ায় পরিচিত পরিজন স্বজনের দিকেও কিন্তু তেমন গভীর জটিলতায় নিয়ে যান না আবেশ। তাঁর লেখায় নিছকই কথা দিয়ে কথাকে আড়াল করে রাখার কথনশৈলী ধরে রাখে ভৌতিক উৎকণ্ঠা। তারপরই পাঠানুভূতির আকস্মিক প্রতিসরণ। লঘু অনুসন্ধিৎসা থেকে ঘন অনুভবে (পুরনো মিটসেফ)।
      ‘বাংলায় কথা বলতে পারেন?’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভাল লাগে কম্পন। সবকিছু ধ্বসে যাক এমন আকাঙ্ক্ষা কি অন্তর্লীন? যাপনে ব্যর্থ ধ্বংসকামী চিন্তনপ্রবাহ মুহূর্তে বদলে যায় যখনই মাতৃভাষায় কথা বলতে পারার একটা মামুলি দক্ষতা উঁকি মারে আলম্বন-সম্ভাবনায়। ভালবাসার ‘শেষ ঠিকানায়’ ভাল বাসা পেতে গিয়ে কতটা বিপ্রতীপ অভিজ্ঞতায় পৌঁছবে সাগর সে প্রশ্ন আদর্শ ছোটগল্পের ব্যাকরণসম্মত নান্দনিকতায় পাঠকের মনে জাগিয়ে তুলবে উত্তরতৃষ্ণা।
      শেষের আগের গল্পটি মনে পড়িয়ে দিতে পারে একটা টিভি সেট বিজ্ঞাপনের পুরনো ক্যাচলাইন। প্রদর্শনকামী সমাজে ‘আপনার গর্ব পড়শির ঈর্ষা’ সংস্কৃতির বার্তাবাহক হয়ে ওঠার জন্য ঝুটো গয়না তো অনেক বেশি, দামি সিগারেটের একটা ফাঁকা প্যাকেটই যথেষ্ট নয় কি? আর শেষ গল্পটায় ‘দুটো দেশলাই কাঠি’ নিজেরা জ্বলে উঠল না, কিন্তু ভূতের গল্প ভেবে মাঝপথে পুলক জাগে যাঁদের তাঁদের জন্য চড়ুইভাতির আয়োজন করে রেখেছে এমন একটা আগ্নেয়গিরির সানুদেশে অধুনা যার নাম রেইনবো মুভমেন্ট।
      লেখকরা নামকরণের সময় বর্ণনামূলক, রূপকার্থক, চরিত্রকেন্দ্রিক—নানাবিধ প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। অবশ্যই সেগুলি বিষয়বস্তুর চাহিদাভিত্তিক। সেই চাহিদার নিবৃত্তি পাঠকের তৃষ্ণা জাগিয়ে তুলতে পারলে লেখকের তৃপ্তি, প্রকাশকেরও পরিত্রাণ। মাত্র একশো সত্তর টাকার বিনিময়ে ছোটগল্পের এই সংকলন শুধুমাত্র বিষয় বৈচিত্রের কারণেই রেখে যায় আনন্দপাঠের বর্ণময় আবেশ।

পুরনো দিনের ছবি/ আবেশ কুমার দাস/ হাওয়াকল/ মূল্য: ১৭০ টাকা

No comments:

Post a Comment