।। তপোভাগ। : চতুর্থ পর্ব ।। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় ।।


চিত্রঋণ – দয়িতা সরকার 




তপোভাগ  :  চতুর্থ পর্ব


ওরা জলের পাশে পাশে যায় জলের সঙ্গে সঙ্গে ওরা নেচে নেচে যায় নাচ ওদের অঙ্গে অঙ্গে, অঙ্গ ওদের সুনিপুণ, লঘুভার ক্ষিপ্র জলের পাশে পাশে ওরা চলে, জলকে সঙ্গে নিয়ে চলে? নাকি জল ওদের নিয়ে চলে? অথবা হয়তো ওরাও চলে, জলও চলে, একসাথেই, একই স্রোত, তরল, নৃত্যছন্দ,  সাবলীল গতিময় অথবা যেন দুই বেণী, পরস্পরকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে অাঁকড়ে বাঁচে জীবৎকাল জল ওদের পাশে পাশে থাকে না, জল কোথাও থামে না, নদী থাকে, খাত থাকে, জল বয়ে চলে ওরাও চলে ওরা চলে ওদের পশুদল নিয়ে, ওদের উপকরণ নিয়ে চলতে চলতে মাঝে কোন বসতি পড়ে কোনও ছোটো গ্রাম কয়েকটিই মাত্র ঘর কষ্টেসৃষ্টে থাকা মানুষজন তাদের পাশে তারা কয়েকদিন থেকে যায় তাদের ক্ষেতে থাকে তারা অস্থায়ী আবাসে, পশুগুলি মলমূত্র ত্যাগ করে ক্ষেতগুলিকে সারবান করে খেলা দেখায় শরীরে তারা প্রত্যেকেই দড়, জন্মকাল থেকে অতি অভ্যাসে শারীরিক দক্ষতাগুলি অনায়াস হয়ে যায় তাদের লম্বা করে ধরে রাখা বিংশতিহস্তপ্রমাণ বংশদণ্ডের ওপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে নাচ করাও তাদের পক্ষে যতো সহজ, লম্ফ দিয়ে পা বদল করে নেওয়াও ততোই সাবলীল শিশুরা, নারীরা, পুরুষরাও পুরুষরাও নৃত্যপর, গান তাদের কণ্ঠেও খেলা করে নারীরা তো বটেই তাদের নাচ দেখতে, তাদের গান শুনতে আসে গাঁয়ের লোক, কিছু কিছু দিয়ে যায় তাদের নাচ দেখে, খেলা দেখে মুগ্ধ হয় তারা, গান শুনে বিমোহিত হয় কিন্তু তাদের ঘৃণা করে
 ঘৃণা করে, কারণ তাদের বুঝতে পারেনা ওরা তারা জলের পাশে পাশে যায়, তাদের কোন ঠিকানা নেই, কোন মোহ নেই বন্ধন নেই, কিছু উৎপাদন করেনা তবু খাদ্য জুটে যায়, এবং তারা পারদর্শী দৈহিক খেলা বা নৃত্য বা গীতে তাদের পারদর্শিতা গ্রামবাসীদের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে, অলৌকিক ক্ষমতা বলে মনে হয় তারা ভাবে, স্বয়ং ইন্দ্রদেব রক্ষা করেন এই নারীদের, পুরুষদেরও, তাঁরই এরা অনুচর, ইন্দ্রজাল তাই এদের সহজাত, এরা মায়াবী
 ওরা মায়াবী চক্ষের নিমেষে  উধাও করে দিতে পারে হাতের তালুতে রাখা আমলকি ফল, যে কারোর মাথায় হাত বুলিয়ে বের করে আনে কপোতপক্ষীর অণ্ড রূপ বদল করতে পারে মুহূর্তমধ্যে, যাকে কদাকার কুরূপা মনে হচ্ছিলো কয়েক মুহূর্ত আগে, তার পায়ে প্রাণ আছাড় খেয়ে পড়ে, এমন মায়া!
ঘৃণা করে, কারণ ওরা সংসারী নয় নদীর মতো ওরা চলে পাড় ভেঙে ভেঙে, জলের মতোই তারা সহজ সংসারী মানুষদের বিধিব্যবস্থা ওদের সাথে মেলে না
  ঘৃণা করে, কারণ ওরা সামাজিক নয় যেমন সমাজ চেনে লোকেরা, তেমন সমাজ নয় ওদের ওদের সমাজ ওদের মতোই বন্ধনহীন এবং গতিময় ওদের সমাজকে চেনেনা গাঁয়ের লোক অমন আদিম সমাজ থেকে বিবর্তিত হয়ে গ্রামে বসেছে তারা নিজেরাও কবে কিভাবে এসব হয়েছে, তা দূর অতীত, গাঁয়ের লোকেদের তা আর মনে নেই এমন যে ছিলো, তাই মনে নেই এই শৃঙ্খলহীন মানুষদের প্রতি তাই তারা মুগ্ধ হয়, কিন্তু ঘৃণা করে এই দক্ষতাকে তারা মায়া ভাবে এই সব বিদ্যাকে তারা ইন্দ্রজাল ভাবে এই দক্ষ ঐন্দ্রজালিক মায়াবী মানুষদের দেখে তাদের বুক কাঁপে, সেই শিরশিরানি রোমাঞ্চ দেয়, দেয় সমীহ, আবশ্যিকভাবে এনে দেয় ঘৃণা
 অথচ, মেয়েরা আসে দুপুরে, পুরুষরা সকালের দিকে বা বিকেলে মেয়েরা আসে অলৌকিকের আশায়, শিকড় কবচ মন্ত্রের আশায়, ছেলেরা আসে তাদের নারীদের টানে একফোঁটা হাসিমুখ, একটু কটাক্ষ তাদের ধন্য করে, আরো লোভ বেড়ে যায় যদি আরো কিছু পাওয়া যায়! তাদের বৈচিত্র্যহীন জীবৎকালে লবণ সঞ্চারিত হয় রাত্রে আপন নারীকে আদর করার সময় উন্মত্ততা অধিক হয়, প্রায় আলোকহীন ঘরের ভেতর নিজের নারীর অবয়বে ভেসে ওঠে দিনের বেলায় দেখে আসা অপ্সরাটির মুখ
 ওরা অপ্সরা ওরা গন্ধর্ব ওরা দক্ষ ওরা সাবলীল ওরা জলের পাশে পাশে যায়, ওরা জলের সাথে সাথে যায়
নগর ওরা এড়িয়ে যায় পথে নগর পড়লে ওরা পথ সামান্য ঘুরিয়ে নেয় নগর থেকে দূর দিয়ে যায় নগর বড্ডো উগ্র, নগরের চাহিদা বড্ডো উগ্র নগর বড্ডো বেশি নিংড়ে নেয় ওরা শিল্পী, শিল্পের আনন্দ উপভোগ করা তাদের যাপন নগর শিল্প নেয়, বড্ডো বেশি নিতে চায় নগরে প্রয়োজন বড্ডো বেশি, বড্ডো প্রবল, বড্ডো তাৎক্ষণিক এখনই চাই এখনই চাইয়ের সেই দাবী বিকৃতি দেয়, কলুষ দেয়, ওদের শিল্পীমন নগরে স্বস্তিবোধ করেনা, নগর থেকে তাই ওরা দূর দিয়ে যায়
 নগর কিন্তু ওদের ছাড়েনা ওদের বিদ্যা, ওদের দক্ষতা ওদের মায়াকে নগর চায় নগরে অনেক প্রয়োজন, তা সিদ্ধ করতে ওদের বিদ্যা কাজে লাগে, ওদের মায়া কাজে লাগে
গ্রামের পাশ থেকে বসতি উঠিয়ে নিয়ে আবার নদীর পাশে পাশে চলতে শুরু করে তারা দ্যাখে, দলে নতুন কেউ যোগ দিয়েছে কোন সুন্দরী কুতুহলী হয়তো ভুলেছে কোন পুরুষের কণ্ঠের মায়ায়, কোন রোমাঞ্চপ্রিয় কিশোর হয়তো শিল্পের টানে সঙ্গ নিয়েছে অথবা হয়তো মায়াবিনীর মায়ায় পড়ে কেউ চলে এসেছে গলবদ্ধরজ্জু প্রাণীর মতো
 কমেও যায় কেউ দল থেকে হয়তো এই চলা, ক্রমাগতই চলা, অনিশ্চিতের দিকে অনির্দিষ্ট এই চলা বইতে না পেরে কেউ বিশ্রাম চায়, বাকি জীবনটা সুঠাম শরীরের কোন কৃষকের কণ্ঠলগ্না বধুটি হয়ে বসে যেতে চায় বাকিজীবন অথবা সামান্য ভূমিখণ্ডের আশায়, গ্রামের কোন সরলা বালিকার আশায় কেউ রয়ে যায় মাঝপথে তারপর বাকি সারা জীবনটি কাটাতে কাটাতে তারা ভাবে তাদের ফেলে আসা জীবনে কতো রোমাঞ্চ ছিলো...
কেউ আসে, কেউ যায় যূথ চলতে থাকে
 অপ্সরা আর গন্ধর্বের দল চলতে থাকে, নিতে নিতে, নতুন নতুন বিদ্যা শিখতে শিখতে


*   *   *   *   *   *   *   *   *   *   *   *   *  
তার স্বভাব একা একা ঘোরা কতো কি দেখা যায় এই পৃথিবীর, হঠাৎ পথের পাশের ছোটো ফুলগাছটির দিকে চোখ যায়, অদ্ভূত রঙ ও গড়ন  যেমনটি সে আগে দেখেনি, যেখানে অন্য কোনও সঙ্গী থাকলে সঙ্গটাই প্রধান হয়ে ওঠে দেখা হয়না কিছু, শোনা বাকি থেকে যায় কতো কি! এই যে এখন সে এই পাহাড়ি পথে অশ্বপৃষ্ঠে ফিরছে, এই বিকেল, অশ্বক্ষুরশব্দে কতো শব্দ ঢেকে যাচ্ছে সব শুনতে পাচ্ছেনা সে যেভাবে সে পৃথিবীকে আগে দেখতো, সেভাবে দেখতে পায়না আর পায়, অবকাশ পেলে কিন্তু সর্বক্ষণই রাজকার্য, অবকাশ কই? নৃপতি তাকে ভরসা করেন, জরুরী দৌত্যে পাঠিয়েছেন দূর রাজ্যে, অন্যসময় নৃপতির সেনাবহিনীতে তার দায়িত্ব থাকে তার দক্ষতায় ও পরিশ্রমে নৃপতি সন্তুষ্ট, সন্তুষ্ট তার উর্ধ্বতন নায়ক তবু সে জানে, এদের অন্তরে সে নেই তার দক্ষতা আছে, পরিশ্রম আছে, তার অবদানকে তারা স্বীকার করে কিন্তু তাকে মেনে নিতে তাদের সময় লাগবে
এই উপলবন্ধুর পার্বত্য ভূমিতে অশ্ব চালাতে হয় সাবধানে হুমড়ি খেয়ে একবার পড়লে আর থামা যায় না, গড়িয়েই যেতে হয় যদিও এই পথে ঢাল ততো বেশি নয়, তবু দ্রুততা পরিহার করতেই হয় প্রতিটি প্রাণীই তার ভারসাম্য রক্ষা করতে জানে, এসব স্থানে প্রাণীটির ওপরই সিদ্ধান্ত ছেড়ে রাখতে হয় কনকাশ্ব নিজেই চলছে পথ বেয়ে, শামপোক তার রজ্জু ধরে আছে মাত্র
তার স্বভাব একা একা ঘোরা সে যখন আশেয়াতীরে তাদের বসতি ছিলো তখনও সে অরণ্যে যূথের সঙ্গে যেতোনা, একা একা যেতো তাতেই তার রোমাঞ্চ ও পুলক অস্ত্র থাকতোই, কিন্তু চোখকান খোলা থাকলে অস্ত্র দরকার হয়না, অন্ততঃ নিজেকে বাঁচাতে চোখকানই যথেষ্ট আর হাতপাগুলি বসতির সবকয়টি কুকুরই তাকে ভালোবাসতো, সঙ্গ ছাড়তে চাইতো না, তাই তাদের এড়িয়ে তাকে বেরোতে হত সাবধানে অরণ্যে একা নিজেকে বাঁচানো কোনও সমস্যাই নয়, কিন্তু আর কেউ থাকলে সমস্যা একটি প্রাণীও সঙ্গে থাকলে অন্য মানুষ, সে যদি যথেষ্ট আটবিক না হয়, সে জঙ্গলের ভাষাই বুঝবেনা দূরে ময়ূর ডেকে উঠলো, তাই শুনে শরধনু নিয়ে দৌড়ে যাবার আগে বোঝা প্রয়োজন, যে সে বাঘ বা চিৎরাং দেখে ডাকলো? নাকি অন্য কারণে? কি কারণ সেটা? অরণ্যে পদছাপ দেখা জরুরী পথের মাঝখানে একটি বাঁকা সর্পিল রেখা প্যাঁচ অত্যন্ত বেশি অর্থাৎ সাপটি বিষধর সেই রেখাটির ডানদিকের পাড়ের দেওয়াল বামদিকের থেকে বেশি উঁচু অর্থাৎ সাপটি ডানদিক থেকে বাঁদিকে গেছে সর্পিল রেখাটির দু'পাড়ের দেওয়াল কতখানি ভেঙেছে মৃদু অরণ্যবাতাসে, কতো পাতা কুটো উড়ে তাতে পড়েছে তা দেখে বোঝা যায় সাপটি অনুমান কতোক্ষণ আগে পেরিয়েছে চোখকান খোলা রাখলে সব জানা যায়, হাতপা তৈরি থাকলে সমস্যা এড়ানো যায় সবাই তা জানে না, পারেনা তাদের সাথে অরণ্যে আসা বিরক্তিকর ও বিপজ্জনক তাদের বাঁচাতে গিয়েই বিপদ আসতে পারে টঙার জন্য, টঙার জন্য সে ধরা পড়ে গিয়েছিলো, নইলে তাকে আয়ত্ত করা ওই মূর্খ শ্বেতদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না
 কুকুর নিয়ে অরণ্যে আসা আরো বড়ো ভুল, একা এলে যুথে এলে, সমবেত শিকার, কুকুরদল থাকলে সুবিধে কিন্তু একা এলে, সঙ্গের কুকুরটি যদি অত্যধিক শিক্ষিত না হয়, তো সমস্যা হয়ই কুকুর এক অত্যধিক কৌতুহলী প্রাণী, কৌতুহল তাকে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যা থেকে অনেক সময়ই বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে সেবার কালুয়া চিত্রাঙের মুখে পড়েছিলো, আরেকটু হলেই তার খাদ্য হয়ে যেত, সে ঘটনা মনে পড়লে এখনো  হাসি পায় তার
 কনকাশ্ব অনেকক্ষণ জল খায়নি মাঝেমধ্যে সরু সুতোর মতো একটা  রেখা চকচক করছিলো নিচে, ক্রমশঃ চওড়া হচ্ছে সেটা, অর্থাৎ দূরত্ব কমছে কোনো পাহাড়ি জোড় হবে এদিকে এরা বলে ঝোরা আরেকটু, বেটা কনকাশ্ব, আরেকটু নামি চল, তোকে জল খাওয়াবো, আমিও তো খাবো


*  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  * 


দুপুরটি শুনসান খাঁ খাঁ রৌদ্র বাইরে, এই কক্ষের ছাদ বেশ উচ্চ, তাই ছাদের রৌদ্রতাপ নিচে অব্দি আসেনা উষ্ণতা অবশ্য ছড়ায় কক্ষমধ্যে, সেই উষ্ণতা শমিত করতে পাঁচজন কিঙ্করী সর্বদা ব্যাপৃত থাকে, যখন ভোজরাজ তাঁর এই বিশ্রম্ভাগারে থাকেন এখন দ্বিপ্রহর অতীত হয়ে দুইদণ্ডের কিছু অধিক সময় হয়েছে, কুন্তীভোজ দ্বিপ্রাহরিক আহার সমাপনান্তে বিশ্রামে রত পশ্চিম গবাক্ষপার্শ্বে বৃহদাকার একটি তালীপত্র নিয়ে বাইরের বায়ু ঘরের ভেতর টেনে আনছে একজন, দক্ষিণদিকের গবাক্ষ এখন বন্ধ করে রাখা আছে, উত্তরদিকের বাতায়নে দুইজন ব্যস্ত, পূর্বে এই কক্ষের দ্বার, সেখানে ভেতরে চারজন নারী, বাইরে দু'জন পুরুষ সশস্ত্র প্রহরায় আছে নৃপতির মাথা থেকে কটিদেশ অব্দি একজন, কটি থেকে পাদমূল অব্দি আরেকজন তালীপত্রবীজনে রত দুইজন সংবাহিকা অঙ্গসংবাহন করে চলেছে, বহুক্ষণ ধরে ধীর, নিষ্পন্দপ্রায় শরীর নৃপতির, প্রথমে তাঁর দক্ষিণ অংস ঈষৎ উঁচু হলো তারপর বামাংস, সংবাহিকারা থেমে গেল, নৃপতি উপুড় অবস্থা থেকে চিৎ হলেন
 সংবাহিকারা থেমে আছে, কিঙ্করীরা আরো দ্রুতবেগে বাতাস করছে, ভোজরাজ চোখ খুললেন সংবাহিকাদের দিকে তাকালেন, তারা আবার কাজ শুরু করলো
  আঃ এই তাম্বুল এক অতি আশ্চর্য বস্তু কি মধুর এর স্বাদ মাংসভক্ষণে তো বটেই, এমনিতেও প্রতিবারই খাদ্যগ্রহণের খানিক পরে চোয়ালের দুইপাশে, গালের নিচের দিকে একটি অস্বস্তি হয়, কেমন যেন গা গুলোয়, অথচ উদর পূর্ণ হবার একটি তৃপ্তিও থাকে খাদ্য কিছু কম ভক্ষণ করলে অবশ্য মাঝেমাঝে তা থাকেনা, কিন্তু ক্ষুধা থাকলে, খাদ্য থাকলে খাবেন না কেন তিনি! খান, এবং তারপরে এই গা গুলোনো অস্বস্তি বৈদ্য বলেছিলো তাম্বুল নিতে, খাওয়ার পর বৈদ্য নিজে অবশ্য তাম্বুল নেননি কখনোই, ওসব অনার্য ব্যাপারে তিনি অভ্যস্ত হতে চান না, গোমহিষাদির ন্যায় কচর কচর করে কতকগুলি বস্তুকে একটি পত্রে মুড়ে চর্বণ করতে তাঁর ব্যক্তিত্ব আহত হয়, নিজেকে রোমন্থক প্রাণীতুল্য বোধ হয় কুন্তীভোজ কিন্তু তাম্বুলচর্বণে অলৌকিক সুখ পান, খাবার পর তার আর গা গুলোয় না অনার্য অভ্যাস আবার কি! ইদানীংকার কোন অভ্যাসটি অনার্য নয়? এই যে বিবিধ প্রকারের শষ্পরাজি থেকে প্রস্তুত ব্যাঞ্জনসমূহ, এই যে উৎকৃষ্ট ধান্যের অন্ন, আহারের মূল ভাগ তো এগুলিই, এগুলি সবই তো কৃষ্ণকায় মানুষদের থেকে শিখে নেওয়া অনার্য অভ্যাস বলে এগুলি সব বাদ দিয়ে কি মানুষ ঝলসানো কিম্বা কাঁচা মাংস খাবে নাকি? গুহাতেও বসবাস করতে হবে তাহলে অথবা, কাঠ ও পাতা আর শন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ছাউনিতে থাকতে হবে সেসব সম্ভব আর?
অনেকে এই আর্য ঐতিহ্য, অনার্য অভ্যাস নিয়ে অতি চিন্তিত তারা পুরাতন অভ্যাসের মান রাখতে অরণ্যযাপনে যায়, তাকে বনবাস বলে তপস্যার জন্য বন, তপোবন বনে বাস করে কি তপস্যা যে তারা করে, কে জানে! ইদানীং বন আর বন আছে নাকি? যে বনে পদে পদে রোমাঞ্চ নেই, হঠাৎ করে গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে আসা চিৎরাং নেই, যে বনে মাথার ওপর বৃক্ষশাখে হঠাৎ দোল খায়না অহিরাজ, বন্য বৃকদল ঘিরে ধরেনা অকস্মাৎ, সেটা বন? ধিক! অমন বনে বাস করা আর প্রমোদকাননে বাস করা একই ব্যাপার!
অর্ধদণ্ড সময় আছে বিশ্রামের তার মধ্যে প্রস্তুত হয়ে পুনরায় যেতে হবে মন্ত্রণাগৃহে পূর্বচিত্তি এসেছে ভোররাত্রে সে নিয়ে এসেছে পূর্বপ্রান্তের সংবাদ তাকে বিশ্রাম করে সুস্থির হবার সময় দিয়েছেন কুন্তীভোজ এবার, নিতে হবে সব সংবাদ স্থির করতে হবে ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি পূর্বচিত্তি ক্লান্ত থাকলে তার দেহেও সে উত্তাপ থাকেনা, সে দংশন থাকেনা, সঙ্গমকালে বার্তাগুলি সে কানে কানে নিবেদন করে ঠিকই, সঙ্গমটি নেহাৎ শারীরিক ব্যায়াম হয় এবং বার্তাগুলি নেওয়া হয়, এইমাত্র পূর্বচিত্তি স্ফূর্ত হয়ে উঠুক
  উঠে দাঁড়ালেন কুন্তীভোজ সংবাহিকারা সংলগ্ন কক্ষ থেকে দুইটি কাংস্যপাত্র বয়ে আনলো, তাতে সুগন্ধী জল কার্পাসবস্ত্র সেই জলে ভিজিয়ে তারা নৃপতির সর্বাঙ্গ মুছিয়ে দিতে লাগলো স্কন্ধ থেকে বাকি শরীর মস্তক বাদ মস্তকে কাউকে উঠতে দেওয়া নৃপতির শোভা পায়না এবং তা নৃপতির পক্ষে বিপজ্জনকও বটে
নৃপতিকে বস্ত্র পরিয়ে দিচ্ছে একজন, আরেকজন বেটে রাখা চন্দনপঙ্ক লেপন করছে তার বাহুতে, বক্ষে, পৃষ্ঠে ভোজরাজ স্বয়ং তাঁর মাঝের তিনটি অঙ্গুলি চন্দনপঙ্কে ডুবিয়ে নিজের কপালে তিনটি সমান্তরাল রেখা টেনে নিলেন তারপর হাতের ইঙ্গিতে বাকিদের নিরস্ত করলেন তারপর উর্ধ্বাঙ্গে একটি উত্তরীয় টেনে নিতে নিতে বাম পদ ভূমি থেকে সামান্য উঁচু করলেন, একজন তাতে পাদুকা স্থাপন করলো দক্ষিণপদেও সেভাবে পাদুকাস্থাপন হতেই তিনি পা বাড়ালেন পূর্বচিত্তি, পূর্বচিত্তি...

    * *              * *          **           **             **           **

অঘোরে ঘুমোচ্ছে পূর্বচিত্তি আয়ত লোচনপক্ষ্মগুলি একটুও কাঁপছেনা পর্যন্ত সর্বশরীর অসাড়প্রায় কটিদেশে নীবিবন্ধ ঈষৎ আলগা করে রেখেছিলো সে ঘুমোনোর সময়, উর্ধাঙ্গে কোনও বসন নেই বিকীর্ণমূর্ধজা হয়ে শুয়ে রয়েছে সে উপুড় হয়ে পৃষ্ঠের উপরাংশ বিশাল কুন্তলভারে আবৃত, পাঁজরের নিচ থেকে কটিদেশ পর্যন্ত উন্মুক্ত স্বয়ং নৃপতি ছাড়া আর কেউ এ গৃহে আসবেনা কয়েকটি ভূর্জপত্র, কিছু সরু সুত্র, তাতে বিচিত্র কিছু গ্রন্থি, বাঁশি ঘুঙুর সহ বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র, দুইটি দুইহস্তপ্রমাণ বংশদণ্ড, কয়েকটি সরু চামড়ার মশক, একটি ক্ষুদ্র দর্পণ, কাজল লাগানোর দুইটি মুষ্ঠিভর ধাতব কৌটো, দুইটি ক্ষুদ্র ছুরিকা  একটির অগ্র বাঁকা এবন অপরটি একেবারেই ঋজু -- এসব ছড়িয়ে রয়েছে তার চারপাশে মস্তকের কাছে একটি বৃহৎ চর্মথলিকা মধ্যমাকারের কোন প্রাণীর মতো পড়ে রয়েছে, তার অন্দরে অনেক কিছুই আছে বোঝা যাচ্ছে, যা বের করা হয় নি এমন আরো দুইটি চর্মথলিকা প্রাচীরগাত্রে প্রোথিত বাঁশফালি থেকে ঝুলছে প্রগাঢ়যৌবনা তন্বী, পূর্ণ বিকশিত ইন্দীবরতুল্য মুখখানিতে তার, কয়েকটি মক্ষিকা উড়ছে না, সে মারা যায়নি মক্ষিকাদের ডেকে এনেছে তার মুখের বারুণীগন্ধ!
প্রবাদ আছে, পূর্বচিত্তি ঘুমোয় না ঘুমোচ্ছে বলে মনে হয়, কিন্তু সে তার স্থূল দেহ পূর্বচিত্তি যখন ঘুমোয়, তার শিয়রে জেগে বসে থাকেন স্বয়ং দেবী উর্বশী! তাকে জাগাবার প্রয়োজন হলে তিনি একবার স্পর্শ করেন, লহমার মধ্যে পূর্বচিত্তি উঠে বসে, সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে ওঠে তার প্রতিটি অঙ্গ আসলে, তার শিয়রে দেবী উর্বশীকে বসে থাকতে তো কেউ দেখেনি! দেখেছে যে সে অতি অল্পে জেগে যায়, সামান্য পদশব্দে বা একটি চটকপক্ষীর পাখার শব্দে, এবং জেগেই অতি দ্রুত প্রস্তুত হয়ে ওঠে তার বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি দুইবার লাফায়, তারপর তার চোখের পাতা দুটি কাঁপে, এবং অকস্মাৎ সে সম্পূর্ণ জেগে উঠে বসে
যখনই, দূর থেকে পা টিপে টিপে এসে তাকে নিদ্রিত দেখতে ইচ্ছে হয়, দেখা যায় মুহূর্তমধ্যে তার বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি জেগে উঠলো, সঙ্গে সঙ্গেই চোখের পাতা এবং স্বয়ং নায়িকা উঠে পড়লো তার পূর্নবিকশিত দেহবল্লরী ছড়িয়ে, ঠিক যেমনভাবে মেঘাড়ম্বরে কলাপ ছড়িয়ে নৃত্য করতে উদ্যত হয়ে ওঠেন বিহগরাজ ময়ূর
এখন সে ঘুমোচ্ছে দীর্ঘ পরিশ্রমের পর শারিরীক ক্লান্তির ঘুম, বড়ো সুখের ঘুম কেশভারে প্রায় ঢেকে থাকা পিঠ উঠছে নামছে মৃদু সে স্পন্দনে সর্বশরীর জীয়ন্ত


সখী জানপদী, সখা বিশ্বক জানে এখন, এই সময়ে তার নিদ্রার প্রয়োজন। তারা ভুলেও এ কক্ষে আসবেনা এখন। শুধু নৃপতি কুন্তীভোজ আসবেন, যে কোন সময়ে, তাঁর আগমনের সংবাদ পেলেই তাকে জাগিয়ে দিতে হবে। 
পূর্বদেশ, সে এক অদ্ভূত অনুভূতি। পর্বতগুলি ছোটো ছোটো, হিমশীর্ষ নয়, স্বচ্ছন্দে আরোহণ করা যায়। নদীগুলির প্রসার বেশি। বায়ু সেখানে অনেক বেশি জলীয়। মানুষগুলিও অন্যরকম। আকারে ঈষৎ খাটো, প্রসারেও কিছু বড়ো নয়, কিছু অধিকমাত্রায় উচ্চকিত যেন, সর্বদাই যেন প্রস্তুত। কিসের জন্য? কিছু না কিছুর জন্য। নগর তো বটেই, গ্রামগুলিও। রাজধানীটির তো কথাই নেই।
 
হবেনা কেন! এক আশ্চর্য পুরুষ সেখানকার অধিপতি। কতো প্রকার জনশ্রুতি তাকে নিয়ে, কতো প্রকারের গল্পগাথা! অবিশ্বাস্য মনে হয়! গন্ধর্ব এবং অপ্সরারা বিভিন্ন ধরণের মানুষকে মোহিত করতে জানে, সে শিক্ষা বাল্যাবধি তাদের আয়ত্ত করতে হয়, তাই তাদের ব্যক্তিত্ব বেশি, অন্য কারোর ব্যক্তিত্বে তারা প্রভাবিত না হতে সক্ষম। কিন্তু এই একটি মানুষ, এই বিরাট একটি পুরুষের সামনে তারা কুঁকড়ে গিয়েছিলো, প্রথম সেই দেখার কথা মনে পড়লে বিশ্বক এখনো রোমাঞ্চিত হয়। মানুষটির নিজস্ব প্রভা আছে, তার সামনে দাঁড়ালে গা শিরশির করে, শরীরে মৃদু কম্পন হয়! চণ্ডকৌশিক নামে মুনির কৃপায় নৃপতি বৃহদ্রথের বংশে এই পুত্রটি নাকি দুই যমজ মাতার একত্রিত সন্তান। নাকি জরানাম্নী রাক্ষসীর দান সে। নাকি তার যে জীবন, তা সেই রাক্ষসীরই দান।
তিনি এক অলৌকিক পুরুষ। তাঁর নাম, জরাসন্ধ।



No comments:

Post a Comment