।। বাক্‌ ১২৩ ।। আমার বাবা - বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় ।।










পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে আদ্রা এই ছোট রেল শহরটিই ছিল পুরুলিয়া জেলার সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র কবি জগন্নাথ মুখোপাধ্যায়ের ছাতনার দোকান বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের নিয়মিত আড্ডায় মেতে উঠতএকে  কেন্দ্র করেই জেলার সাহিত্যচর্চার বলয়টি বিকশিত হয় কবি কানন দত্তের  সম্পাদনায় আদ্রা তখন  থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হত মাসিক পত্রিকা শঙ্খ  প্রথমে হাতে লেখা পত্রিকা হিসেবে  প্রকাশিত হলেও এবং পরে তা মুদ্রিত কলেবরে আত্মপ্রকাশ করে। জেলার মানচিত্র অতিক্রম করে সহজেই তা  সারা বাংলার কবিতাপ্রেমী মানুষের আলোচনা ও চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের দিকপাল সাহিত্যিকরা এতে লিখতেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে কবি কৃষ্ণেন্দু  দত্ত শঙ্খ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন এবং পাশাপাশি ঊষষী নামে অন্য একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতে শুরু করেন শুধু ব্লক বা জেলা নয় বাংলা সাহিত্যেও এই দুটি পত্রিকার অবদান অনস্বীকার্য ।  
  পুরুলিয়া জেলার বঙ্গভুক্তির পর এই জেলায় সাহিত্যচেতনায় নবজাগরণের সূচনা হয়।  ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে জেলার  বাংলা সাহিত্যের  সমকালীন  প্রবাহবাংলা ক্ষুদ্র পত্র পত্রিকার জন্ম হতে শুরু করে ছয়ের দশকে ছোট  কাগজের  জগতে উন্মাদনা আরও গভীরতর হয় । এই  দশকের একেবারে সূচনালগ্নেই  (১৯৬২ সালে ) অধ্যাপক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়  আদ্রা সংস্কৃতি চক্রের মুখপত্র কৃষ্ণচূড়া আত্মপ্রকাশ করে দিলীপবাবু  ছিলেন রঘুনাথপুর কলেজের বাংলার অধ্যাপক।রঘুনাথপুর শহরে শুধু নয় সারা জেলাতেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সাবলীল গদ্যের কৌলীন্যে তিনি সহজেই নিজের স্বতন্ত্রতা চিহ্নিত করেছিলেন।ছোটখাটো চেহারায় এই মানুষটি তাঁর দীর্ঘ ছায়া বিস্তার করেছিলেন। বাবার সাথে তাঁর পরিচয় ছাতনার দোকানের সাংস্কৃতিক আড্ডায়।পরে কৃষ্ণচূড়ায় লেখালেখির সুবাদে তা বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছায়। এই পত্রিকাকে নিউক্লিয়াস করেই উজ্জীবিত হয়ে ওঠে  সারা জেলার সাহিত্যের আড্ডা কবি  কালিপদ কোঙার দেশ এবং অমৃতে তখন নিয়মিত লিখছেন।কর্মসুত্রে তিনি তখন রেল শহর আদ্রায়। তাঁর এবং কমল   চট্টোপাধ্যায়ের যুগ্ম  সম্পাদনায়  ১৯৬৩ সালে  বিচিত্রা ( পরে সাহিত্য বিচিত্রা নামে পরিচিতি লাভ করে ) প্রকাশের সাথে সাথে  জেলার সাহিত্য জগতে তীব্র উচ্ছ্বাস এবং আগ্রহ তৈরি হল । মেলবন্ধন ঘটল জেলার সাহিত্যের সাথে কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যের ।  কালিপদ কোঙার , কবি  প্রাবন্ধিক এবং সুবক্তা  বিমলকান্তি ভট্টাচার্য , কবি  জগন্নাথ মুখোপাধ্যায় , নিত্যানন্দ মুখোপাধ্যায় , রণজিৎ চট্টোপাধ্যায় , কামাখ্যা সরকার , শীলা সরকার , জ্যোতিষ সরকার ,  কমল চট্টোপাধ্যায় জগদীশ সরখেল , সিরাজুল হক যুধিষ্ঠির মাজী এঁদের নিয়মিত উপস্থিতিতে জগন্নাথবাবুর ছাতনার দোকানের আড্ডা তখন জমজমাট।এই সমস্ত গুনীজনের উষ্ণ বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার টানেই বাবা বারবার ছুটে আসতেন এখানে। বাবাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন এঁরা সকলেই। তখন কবিতার পরিমণ্ডল ছিল অন্যরকম। সৌভাতৃত্ব এবং প্রীতির টানে একে অপরের সাথে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। সকলে মিলে যেন এক বৃহত্তর পরিবার।      
 আদ্রায় এই সাংস্কৃতিক আড্ডা ও আলোচনার একজন অংশীদার হয়ে ওঠেন বাবা নিজেও কবি প্রাবন্ধিক বিমলকান্তি ভট্টাচার্য , কামাখ্যা সরকার  এবং  কবি কালীপদ কোঙারের সাথে তীব্র বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তখন শিয়ালডাঙ্গা থেকে আদ্রা আসা এখনকার মতো এরকম সহজসাধ্য ছিল না শিয়ালডাঙ্গা থেকে সিরজাম তিন মাইল কাদাপথ  হেঁটে আসতে হতমাঝখানে ডাংরা নদী যা বর্ষাকালে প্রায়ই বিচ্ছিন্ন করে দিত সমস্ত সংযোগ ব্যবস্থা সিরজাম থেকে আদ্রা সারাদিনে তিন জোড়া ট্রেন সন্ধ্যে সাড়ে ছটার ট্রেন ফেল হলে বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ত গভীর রাতে ট্রেন থাকলেও তাতে বাড়ি ফেরা প্রাণ হাতে নিয়ে আসার মতোই ভয়ঙ্কর চারদিকে সমাজবিরোধীদের উপদ্রব ছিল সীমাহীন তবু অধিকাংশ দিন আদ্রার এই সাংস্কৃতিক আড্ডা থেকে ফিরতে ফিরতে বাবার এরকমই রাত হয়ে যেতকারণ ট্রেন ধরার অঙ্কে বাবার হিসেব নিকেশ ছিল বরাবরই অদ্ভুতঘণ্টা দেড়েক আগে বেরিয়ে দ্রুত গতিতে হেঁটেও বাবাকে অনেকবার ট্রেন ফেল করতে দেখেছি বড় হয়ে এর কারণ রাস্তায় কখন কার সাথে দেখা হয়ে যাবে তা অনিশ্চিত এবং সেই লোকটি যদি খুব ভালো শ্রোতা হয় তাজলে তো আর বলার কিছু নেইতাকে চা চপ খাইয়ে তার সাথে গল্পে জমে উথবেন বাবা তখন আর খেয়ালই থাকবে না ট্রেনের কথাকেউ হয়তো মাঝপথে ট্রেনের কথা মনে করিয়ে দিল তখন হয়তো আর জোরে জোরে হেঁটেও ট্রেন মিলবে না 
কবিতার জমজমাট আড্ডা পেলে তো  তার স্বাদ অন্যরকম কত যে দেরি হবে তা  শুধু ঈশ্বর জানেন বিমলকান্তি ভট্টাচার্য, কামাখ্যা সরকার কালীপদ কোঙার এদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিরলস আড্ডা থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য  উঠে আসে বহুদর্শী এই মানুষগুলির স্মৃতির ভেতর  এক একটি চলমান  গ্রন্থাগার
সেই সময় এই জেলায় যারা উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো লিখতেন তাঁদের মধ্যে কালীপদ কোঙার ছিলেন অন্যতমযদিও জন্মসূত্র নয় কর্মসুত্রেই পুরুলিয়ার সাথে আদ্রার সাথে তার আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল রেলের অ্যাকাউন্টস বিভাগে দায়িত্বশীল পদে চাকরি করতেন তিনি  কালীপদ কোঙারের সাথে বাবার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল সহজেইএই মানুষটির প্রসঙ্গে বাবার কাছে নানা গল্প শুনেছি বিভিন্ন সময়েআমার নিজেরও সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর সাথে গল্প করবারকবিতা নিয়ে আলোচনা করবার সেসব অবশ্য  আমার স্কুলজীবনের কথাতখন তিনি কবিতা থেকে স্বেচ্ছানির্বাসিত এবং দ্বিতীয়পর্বের লেখালেখি শুরু করবেন এরকম একটা সময়ে তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেনসেই অভিজ্ঞতা এবং তাঁর স্নেহস্পর্শের কথা পরে একসময় আসবেই 
মানুষটি নিরংকারী এবং বিনয়ী শুধু একজন বিদগ্ধ সুশিক্ষিত মানুষএকদিন ট্রেন খুব লেট  ঘণ্টা আড়াই তো হবেই, এতক্ষণ সময় কোথায় কাটাব ভাবতে গিয়ে  বাবার মনে পড়ল কালীপদবাবুর  কথা মনে পড়ল স্টেশনের সামনেই তাঁর অফিসমানুষটিও কবিতা অন্ত প্রাণ দেখা করে আসাই যেতে পারে যেরকম ভাবা সেরকমই কাজ পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা বাবা সোজা চলে এলেন রেলওয়ে অ্যাকাউন্টপ্স অফিস কালীপদবাবু  অফিসেই ছিলেন জরুরি কিছু কাজ করছিলেন বোধ হয় বাবাকে  দেখতে পেয়েই ছুটে এলেন সব কাজ ফেলে মোহিনীবাবু আসুন , আসুন
বাবা বললেন  এত বিব্রত হওয়ার কিছু নেই আমার ট্রেন বেশ  লেট আছেধীরেসুস্থে গল্প করা যাবে
বাবার কাছে শুনেছি শুধু কবিতা নয় নিজের কাজের প্রতিও সমান দায়িত্বশীল ছিলেন তিনি কবিতা গল্প আড্ডার  পাশাপাশি নিজের কাজগুলিও দক্ষতার সাথে করতে পারতেন অনায়াসে, এতে তাঁর কোনরকম অসুবিধে হত না   নিজের কাজকর্ম শেষ হলে বাবাকে  বললেন আসুন আমার সাথে
কোথায় ?
অত প্রশ্নের কিছু নেই যা বলছি শুনুন
আড়াই ঘণ্টার লেট ট্রেন তো আর আমার জন্য দশ ঘণ্টা বসে থাকবে না ?
দূর মশাই, আগে বাড়িতে চলুন তো    
তারপর জোর করেই  নিজের সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে তিনি বাবাকে  নিয়ে এলেন তাঁর কোয়ার্টারে- এই আবাসন শুধু আমার নয় কবিতাপ্রেমী সমস্ত মানুষের আদ্রা এলে এই আবাসনে একবার আসবেনইঅন্তত এক মিনিটের জন্য হলেও  আমার পরিবারের সকলেই কবিতার জন্য নিবেদিত গুনী জনের শব্দে স্পর্শে এবং সান্নিধ্যে এ ভূমি হয়ে উঠবে প্রকৃত সাধনভূমি এরকম বিনয়ী মানুষ ছিলেন তিনিবাবাকে বারবার বলতেন- চারপাশে কত নতুন মুখ দেখেছেন । ওদের নিজস্ব স্বর আছে। মনের ভেতর জমে আছে যন্ত্রণা কিন্তু আত্মপ্রকাশের তেমন ব্যবস্থা নেই। একটা পত্রিকা , মনের মতো একটি পত্রিকার খুব দরকার এখানে।
 আদ্রা থেকে বিলাসপুর বদলি হওয়ার পরও এই আন্তরিকতা অব্যাহত ছিল নিয়মিত খবর নিতেন চিঠিপত্রে
আদ্রায় আরও একটি আড্ডাঘর ছিল শীলা সরকার এবং জ্যোতিষ সরকারের বাড়ি সেখানে শুধু জেলার কবি সাহিত্যিক নয় অনেককেই আসতেন কবি এবং চিত্রপরিচালক  বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাথে বাবার পরিচয় এবং সংযোগ এই আড্ডাঘর থেকেইপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছোটবেলা কেটেছে পুরুলিয়ার আনাড়া রেলশহরে এই শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা এবং শৈশবের শেকড় ছড়ানো স্বাভাবিকভাবেই এই জেলার মানুষের সাথে তাঁর প্রাণের বন্ধন

(ক্রমশ)       
                      

1 comment:

  1. Casinopatra Casinos - Review of Casinopatra's Casino
    Casinopatra's Casino is a well-known online 1xbet 주소 casino, founded in 1999. 스보벳 The casino is 바카라 룰 operated by Gambling Establishment Limited, with 다파벳 a 로투스 바카라 full licence and

    ReplyDelete